বিষ্ণুপ্রিয়া পদ্মাসনা ত্রিতাপহারিণী।
চঞ্চলা অচলা হও পাপনিবারণী।।
তোমার পদেতে মা মোর এ মিনতি।
দুখ নাশিবার তব আছে গো শকতি।।
২: বীরেনের বৌ
সংসারে
‘অখণ্ড পোয়াতি’ দের বড় মান্যি। গর্ভসঞ্চার থেকে শুরু করে প্রসব হওয়া অবধি কাকপক্ষীতে
টের পায়না। সংসার চলে নিজের মনে। ভোরবেলা শাশুড়ীর পূজোর আসন গুছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ছোট ছোট দেওরদের ইস্কুলের ভাত দেওয়া, সন্ধেবেলায়
শ্বশুরমশাইয়ের আফিং টুকু খাওয়ার পর একবাটি ঘন ক্ষীর এগিয়ে দেওয়া, এইসব করেও তারা দিব্য
ষোলো কলার মত বাড়তে থাকে তারপর যথাসময়ে ভিটের সবচেয়ে স্যাঁতস্যাতে ঘরে পুরোনো কাপড়চোপড়ের
ওপর দাইয়ের নজরদারিতে সন্তানের জন্ম দেয়। কাউকে
জ্বালায়না, মৃত সন্তানও প্রসব করেনা। সব সন্তান অখণ্ডায়ূ হয়। এইসব লক্ষ্মীমন্ত বৌদৈর
জনে্যই সংসার উথলে পড়ে। ঠিক যেন মাটির হাঁড়িতে জ্বাল দেওয়া গাইয়ের দুধ। তাই স্ত্রী-আচারে
সাধের, অন্নপ্রাশনের পায়েস রান্নায় সবার আগে তাদের ডাক পড়ে।বিয়ের বরণডালার ‘ছিরি’ তৈয়েরের
অগ্রাধিকার তাদের।
এইভাবেই
শোভনা। ঠিক দেড় বছরের মাথায় করূণা। বীরেন্দ্রনাথ ল’ পাশ করে নতুন শামলা গায়ে চড়িয়েছেন।
পূর্ণলক্ষ্মী চিঠি লিখতে আর ফুলঠাকুরপোকে ডাকেননা। রাতেরবেলা শাশুড়ী দরজা বন্ধ করলে,
কোলের দুটিকে ঘুম পাড়িয়ে টেমি জ্বালিয়ে চিঠি লেখেন। আপনি কবে যেন ‘তুমি’তে গড়িয়েছে।
অনেক বায়না: রবিবাবুর নতুন নবেলখানি, বিলাতি সাবান, মাথায় দেবার গন্ধ তেল,শোভনার ফ্রক, বিস্কুট আরও কত কি। কলকাতা কেমন শহর? সেকি ঢাকার চেয়েও বড়? সেখানে কি
অনেক সাহেব মেম ? বড়লাটের বাড়ি কি ঢাকার নবাববাড়ির চেয়েও…?
আরও অনেক
কথা জমে থাকে। গ্রীষ্মের ছুটিতে বীরেন যখন আসেন তখন সেসব জমা কথার ফোয়ারা দুজনেরই।
সুরেন বাঁড়ুজ্জের দিন শেষ। কে এক গান্ধীর কথা বলেন বীরেন্দ্রনাথ। তিনিই নাকি পরাধীন
দেশবাসীকে পথ দেখাবেন। কিসের পথ…কিছু কুলকিনারা পাননা পূর্ণলক্ষ্মী। খালি যুবক স্বামীর
কথা মাঝরাত জেগে মুগ্ধ হয়ে শোনেন। ‘দেশ’ ‘পরাধীনতা’ ‘প্রথম মহাযুদ্ধ’, নতুন নতুন সব কথা…বাইরে প্যাঁচা
ডাকে।
--“তোমাদের এবার কলকাতায় নিয়ে যাবো ।শোভনা আর করূণার লেখাপড়ার
বয়েস হচ্ছে। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ছি ঘনঘন আর আসতে পারবোনা” ।
১৯২৩। ফরিদপুরের মাদারিপুর সাবডিভিশনের রুকনি গ্রাম থেকে
পাট উঠলো পূর্ণলক্ষ্মীর। তখন সে অন্তঃসত্ত্বা।
কলকাতার ভবানীপুরে ১৯২৪ সালে বরেন্দ্রনাথের
জন্ম। এতদিনে সেজবৌ সত্যি সত্যি পুতের মা।
ভাগি্যমানী সেজবৌ।
৩: কত
সাধ যায় লো চিতে, মলের আগায় চুটকি দিতে…
বরাবরই
ঢাকা শহর নিয়ে গুমোর ছিল সেজ বঊয়ের। ভবানীপুরের বাসাবাড়িতে এসে তার সে গুমোর ভাঙলো।
ভাড়া করা ফিটনে চেপে নিজের সেলাই করা নক্শী কাজ করা জ্যাকেট পরে সেই প্রথম গড়ের মাঠ,
ফিরিঙ্গী কালীবাড়ি, বড়লাটের প্রাসাদ।
---“বাড়ি ফেরার পথে ভীমনাগের
দোকান থেকে এক বারকোস সন্দেশ কিনে দিয়েছিলেন উনি। ছেলে মেয়েদের নিতে দেননি আমার একটু মনখারাপ হয়েছিল,
বুঝেছিলেন”।
সেজবউয়ের
জগৎটা পাল্টাচ্ছিলো একটু একটু করে। কলের জল, গ্যাসের আলো, সারাটা সকাল দুপুর ফিরিওয়ালার
ডাক, রিঠেভেজা জলে চুল ধুয়ে রোদে ফালি ফালি করে চুল শুকোনো। এছাড়া সংসারের হাল ধরার
প্রথম পাঠ। দেশ থেকে সঙ্গে এসেছিলেন খুড়িমা। শাশুড়ী ছিলেন ভিটেবাড়ি আগলে।তাঁর রাজতি্য,
বড় আর মেজ ছাওয়ালের সংসার, বাউণ্ডুলে শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ানো কালীসাধক স্বামী, এইসব
নিয়ে রইলেন তিনি রুকনিতে। পাঠিয়ে দিলেন ছোট দেওরের সংসার। বীরেন তো ছোটবউয়েরর কোলেই মানুষ। ‘খুড়িমা’ বলতে
অজ্ঞান! সেই খুড়িমার হাতেই রান্নার হাতে খড়ি। বোয়াল মাছের ঝোল আলু বেগুন বড়ি দিয়ে।
তাতে আদাবাটা আর টাটকা কাঁচালংকা। রান্না হলে সে ঝোল ঢালা হবে পাথরের জামবাটিতে। শিল
নোড়া দিয়ে ঢাকা চাপা থাকবে সারারাত ছাদে। রাতের হিম পড়ে ভোরের বেলা সেই ঝোল হবে ক্ষীরের
মত ঘন। সকালবেলা জাউ-ভাতে সেই ঝোল ঢেলে বাড়ির গিন্নীরা খাবে। ছেলেপিলে আর কর্তাদের
অন্য বিধান। তারা খাবে সময়ের ফল, ছানা-মাখা, টাটকা দুধ, খই মুড়ি।
কিন্তু
কোথায় একটা গোল বেঁধেছিলো পূর্ণলক্ষ্মীর জগতে। রান্নাবান্না, কুটনোবাটনা, খুড়িমাকে
নিয়ে গঙ্গা স্নান, আরও দুএকটি সন্তানের জন্ম দেওয়া, এসবের বাইরেএকটা অন্য পৃথিবী কখন
যেন তাকে ডাকতে শুরু করেছে। দুপুরবেলা শোবার ঘরে দোর দিয়ে খবরর কাগজের ওপর উপুড় হয়ে
পড়া। বড় দামাল সময়। যাদের শুধু নামে চেনা ছিল তাদের সব ছবি দেখতো মুগ্ধ হয়ে। লোকমান্য
তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিন পাল, আরও কতসব ঠাকুর দেবতার মত মানুষ। খবরের কাগজ যেন
আগুন ওগরায়। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর… গলিতে গলিতে ব্যায়ামের আখড়া আর তাতে উঠতি বয়েসের
ছেলেদের ভীড়। কেন যে এসব আখড়ায় টিকটিকিরা নজরদারি করে তা খানিক খানিক বোঝে সে। স্বদেশীরা কেমন ধারার লোক? তাদের প্রাণে কি ভয় ডর
বলে কিছ নেই? খুড়িমার সঙ্গে এ নিয়ে সে বলতে গেল একদিন। নথনাড়া খাওয়াই সার: “'লঙ্কাতে
রাবণ ম’ল, বেউলা কেঁদে ব্যাকুল হ’ল”!!!
‘বন্দেমাতরম্’
কথাটির মানে জানা হয়ে গেছে ততদিনে। এটাও জানা হয়ে গেছে ও এক মারণ মন্ত্র। ততদিনে
আরও একটি ছেলে হয়েছে তার। বীরেন্দ্রনাথের পশার বেড়েছে।ভবানীপুরের বাসাবাড়ি থেকে
তিনি উঠে এসেছেন বালীগঞ্জের শহরতলীতে। সে পাড়া
ভবানীপুরর মত সরগরম নয়। রাতবিরেতে শেয়াল ডাকে। বাড়ীর নাম ‘প্রসন্ন ভবন’, শ্বশুরমশাই
ঈশ্বর প্রসন্ননাথ লাহিড়ীর নামে। সে বাড়ির মস্ত ছাদের একধারে একটা পুরোনো এনামলের বাথটাবে
পূর্ণলক্ষ্মীর রজনীগন্ধার বাগান । জ্বাজ্জল্য সংসার, সুখের ভাত সুখে খাওয়া, পার্শী
শাড়ি, সোনার ব্যাটবল ব্রোচ্ … দিব্যি কাটছিল দিন। বাদ সাধলো মণিঠাকুরপো। ছেলের মত দেওর।
শোভনার চেয়ে অল্প বড় বীরেন্দ্রনাথের খুড়তুতো ভাই। ছেলে মেয়েদের মণিকাকা।
মলের
আগায় চুটকি দেওয়া কই আর হলো পূর্ণলক্ষ্মীর ?
(ক্রমশঃ…)


No comments:
Post a Comment