এক : সেজবউ
একে ধলীর ধলা গা
তাতে ধলী পুতের মা (মেয়েলী ছড়া)
পূর্ণলক্ষ্মীর জীবনটা কেমন যেন ছিল। জন্ম হয়েছিল
দার্জিলিং-এ ।এক আধা সাহেব বাবা আর এক একটু আধটু পড়তে জানা মায়ের প্রথম সন্তান।
নেপালী আয়ার সঙ্গে থেকে থেকে নেপালীতে কথা বলা শুরু করেছিলো পর্যন্ত! কিন্তু
বেশিদিন পাহাড়ে থ।কা হয়নি পূর্ণলক্ষ্মীর। অকন্যক জ্যেঠামশাই নিয়ে চলে গিয়েছিলেন
ঢাকায়। ছোটবউকে জিগেস পর্যন্ত করেননি তাঁর মত আছে কিনা। মা দূরের মানুষ রয়ে গেলো
তাই সারা জীবন। পরে অবিশ্যি জ্যেঠামশাইর একটি কোল-মোছা মেয়ে
হয়, কিন্তু ততদিনে‘বুড়ি মা’র বিয়ের বয়েস হয়েছে। বয়েস হয়েছে না বলে বয়েস পেরিয়েছে বলাই ভালো।
– “বয়েস বাড়তে বাড়তে সে এক বিপর্যয় কাণ্ড!
তার ওপর জ্যেঠাবাবু একদিন দেখে ফেললেন আমি উঠোনে ভাইদের
সঙ্গে ডাংগুলি খেলছি!”। ব্যস, ভেতরবাড়ীতে এসে জ্যেঠিমার ওপর খুব
খানিকটা চেঁচামেচি করে রেগেমেগে ভাত না খেয়ে আপিস চলে গেলেন। পরেরদিন গেলেন
ফরিদপুর, বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। সেই বরযাত্রীর মধ্যে ‘উনি’ ছিলেন। এম্ এ পাশ দিয়ে তখন কলকাতায় ল’ পড়ছেন। জ্যেঠাবাবু সোজা চলে গেলেন ‘ওনাকে’ নিয়ে ওঁদের গ্রামের বাড়িতে। কথা পাকা করে তবে শান্তি! তারপর সেই যে কথায়
আছে: ওঠ্ ছুঁড়ি তোর বিয়ে…। বাবাকে অবিশ্যি বলেছিলেন জ্যেঠাবাবু একবার কলকাতায়
গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতে, তা বাবা লিখে পাঠালেন: ‘Will attend Buri’s marriage
along with my wife’ ”!
১৯১৪ সালে ঢাকা শহরে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে। পূর্ণলক্ষ্মীর
বয়স তখন বারো। বীরেন্দ্র নাথ বাইশ বছরের পূর্ণ যুবা। কলকাতার বাসায় থাকেন, রবিবাবুর কবিতা
পড়েন, আর সুরেন বাঁড়ুজ্জের বক্তৃতা শুনতে যান টাউন হল।
স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন স্বদেশীদের হয়ে মামলা লড়বেন…তখন কি
জানতেন…সে যাক গে। ছেলেমানুষ বউকে চিঠি-ও লেখেন অ’বরে স’বরে। ছেলেমানুষ বৌএর আরো ছেলেমানুষ ফুল ঠাকুরপো সে চিঠি ডাকসাইটে মায়ের হাতে পড়ার আগেই সেজবৌএর হাতে দিয়ে আসে (“আ-লো, এমন নিলেজ্জ ছাওয়াল, বৌ-রে চিঠি দেয়!) বিনিময়ে পায়
এক পয়সা। সেজবৌএর আধাসাহেব ‘বড়লোক’ বাপ
মেয়েকে তিনটাকা মাসোহারা পাঠাতেন কিনা? ফুলঠাকুরপো ছিলেন সমবয়সী। আর ছিলেন ছোট্ ঠাকুরপো। বিয়ের বারকোসে একথলে
বিলিতি লজেন্স, রঙীন মঠ সব ভরে দিয়েছিলেন জ্যেঠিমা, খিদে পেলে
বউমানুষকে খিদে পেয়েছে বলতে নেই। তাতে সংসারে অলক্ষ্মী লাগে। শাশুড়ী বারকোস থেকে
সেই থলি ভরা মেঠাই ছোট কে দিয়েছিলেন: “আহা, বেয়ানের কি বুদ্ধি…ঘরভরা ছাওয়াল তাই মেঠাই দেছেন”। ছোটর ওপর তাই রাগ ছিল বহুদিন…
পূর্ণলক্ষ্মী জানত না সংসারে বৌমানুষদের একটা মস্ত কাজ থাকে। বুঝলো যখন শাশুড়ী মা একদিন পষ্টাপষ্টি শুনিয়ে দিলেন:
পুরূষের চেয়ে প্রকৃতি সবলা
বিধিরোষে সে নারী অফলা।
সেই প্রথম খনার বচন।
সেই প্রথম লজ্জা।
সেই প্রথম ভয়।
“শ্রীচরণকমলেষু,
বড় ভয়ে ভয়ে আপনাকে চিঠি লিখিতেছি। আজ অবধি আমার ছেলে হয় নাই, একারণে আপনার মাতা আপনার পুনরায় বিবাহ দিবেন। বাড়ীতে ঘটক আসিতেছে। আর আমি ভাল লিখিতে শিখি নাই, ফুল ঠাকুরপো বলিয়া দিয়াছে। ভুল হইলে দোষ তাহার।
প্রণাম জানিবেন।
ইতি আপনার
পুঁটুরাণী।
**************************
–“ও দিদা, ছ—–য় ব-ছ-র? কেন!!! নাতনীর
যুগপৎ অট্টহাসি এবং আর্তনাদ।
–“বলি, ছেলের মা হওয়ার একটা রীতকানুন আছে সেটা বোঝোতো ? কি করে হবে শুনি? তিনি তো আসতেন ছুটিছাটায়। সারাদিনের পরে তোর মা’র ঠাকুরমা যখন সাজিয়ে গুজিয়ে ঘরে পাঠাতেন তখন শুরু হত ‘মেঘনাদ বধ’, ‘সোনার তরী’ মুখস্থ। তারপর Cat mat Bat প্যারীচরণ সরকারের ফার্সট বুক। ঝিমুনি এলেই খোঁপা ধরে ঝাঁকুনি। কম জ্বালিয়েছেন তোদের দাদু সারাজীবন?”
–“বলি, ছেলের মা হওয়ার একটা রীতকানুন আছে সেটা বোঝোতো ? কি করে হবে শুনি? তিনি তো আসতেন ছুটিছাটায়। সারাদিনের পরে তোর মা’র ঠাকুরমা যখন সাজিয়ে গুজিয়ে ঘরে পাঠাতেন তখন শুরু হত ‘মেঘনাদ বধ’, ‘সোনার তরী’ মুখস্থ। তারপর Cat mat Bat প্যারীচরণ সরকারের ফার্সট বুক। ঝিমুনি এলেই খোঁপা ধরে ঝাঁকুনি। কম জ্বালিয়েছেন তোদের দাদু সারাজীবন?”
*************************
পূর্ণলক্ষ্মী মা হয়েছিলেন বিয়ের ছয়বছর পরে। বীরেন্দ্রনাথ
প্রথম মেয়ের নাম রেখেছিলেন শোভনা। শোভনার দৌলতে সেজবউ থেকে মা। তারপর করূণা, বরেন্দ্রনাথ
, বারীন্দ্রনাথ …কোলজোড়া কোলভরা…
সেজবউয়ের বড় দেমাক।অখন্ড পোয়াতি কিনা! ঐ যে কথায় আছে
না…
একে ধলীর ধলা গা…
(ক্রমশ..)

No comments:
Post a Comment