Tuesday, 18 March 2014

পূর্ণলক্ষ্মীর একাল সেকাল (তৃতীয় পর্ব)

Image
                                    ভুবনমোহিনী দেবী
ওই যে বলেছিলাম, পূর্ণলক্ষ্মীর জীবনটা  ছিল কেমন যেন? মা হলো দূর-পর, জ্যেঠিমা দিলো কোল পেতে। শ্বশুরবাড়িরও সেই একই বৃত্তান্ত। শাশুড়ী  রইলেন দূরে দূরে আর খুড়শাশুড়ী ভুবনমোহিনী হলেন সঙ্গের সাথী। ভবানীপুরের দিনগুলো ছিলো ভালো। সকালবলা দুটি ঝোলভাত নামিয়ে দেওয়া খুড়িমার তত্ত্বাবধানে। ঝাঁকা মাথায় মেছুনি দোরে এসে মাছ নামাতো। কর্তাদের আর ছোট ছেলেদের বড় পাকা মাছ। গিন্নীরা খাবেন ঝাল টক। তাই তাদের জন্যে সরপুঁটি,  মৌরলা, বাটা। মাছের ল্যাজা মুড়ো আর সময়ের তরকারি দিয়ে হবে চচ্চড়ি বাড়ির কাজের লোকদের জন্যে। এছাড়া এক গামলা ডাল, নিমপাতা, উচ্ছেভাজা সরু সরু করে বেগুন দিয়ে। শেষ পাতে অম্বল আর ঘরে পাতা দই। সে দই আবার কর্তাদের জন্যে পাতা হবে আলাদা পাথরবাটিতে। ঘাঁটা -পারা দই কখনো তাঁরা খেতে পারেন? কি ঘেন্নার কথা! ভোরবেলা উঠে শুরু হত যজ্ঞিবাড়ির রান্না। আর কিছু হোক চাই না হোক, মাছের ঝোলটুকু আর বড় এক হাঁড়ি ভাত হতেই হবে। বীরেন্দ্রনাথ রাতের বেলা আমিষ, নোনতা কিছুই খেতেন না। কোর্ট থেকে ফেরার পর তাঁর বরাদ্দ একথালা লুচি আর পাথরের বাটিতে লালচে ক্ষীর। ছেলেপুলেদের দুধ-দই,  কর্তাদের ক্ষীর ছানা, তাছাড়া  শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে সংসারটি বেশ ফুলন্ত ফলন্ত,  সাধ, অন্নপ্রাশন, পৈতে লেগেই আছে…দুধ কি কম লাগতো! গোয়ালা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতোনা।  কালে ভদ্রে ছানার ডালনা। তবে সে ছানা আসত বউবাজারের ছানাপট্টি থেকে।
এসব সামলাতে সামলাতে বেলা দুপুর হত। তারপর  শাশুড়ী বউ-এ একটু হাঁপ জিরিয়ে নিয়ে চড়াতেন নিজেদের রান্না।
ভুবনমোহিনী বড় অদ্ভূত শাশুড়ি। ডাক হাঁক নেই, বৌকে সহবৎ শিক্ষে দেবার একছিটে ইচ্ছে নেই। এমনকি পরের বাড়ির মেয়েকে ‘বৌমা’ ডাকার কথাটা তাঁর মনেও আসেনি কখনো। ‘বুড়ি’ তাঁর সঙ্গের সাথী। প্রাণের কথা মনের কথা তারই সঙ্গে। “আ-লো বুড়ি, শুনিচিস, বৌ-খেকো মিনসে এই বউডারেও খাইছে!” পাড়ার ললিত পাকড়াশি মশাই এর দ্বিতীয় পক্ষর মৃত্যুতে ভুবনমোহিনীর অমর উক্তি। তা এরকম আরও কত কথা ছিল তাঁর:
প্রথম পক্ষ হেলাফেলা
দ্বিতীয় পক্ষ গলার মালা
তৃতীয় পক্ষ হরিনামের ঝোলা।
Image
ছড়ার খেলা, বিন্তি খেলা, , কতরকমই না খেলা মেয়েদের। দুপুরবেলা যখন বাড়ির মানুষরা গেছে রাজ্যি জয় করতে আর ছেলেপিলেরা বিদ্যে শিক্ষে করতে,  তখন ভাড়াবাড়ির সরু ঢাকা বারান্দার যেদিকে রোদ পড়তো একফালি, সেখানে দুটি অসমবয়সী নারীর রাজ্যিপাট। সামনে ঝকঝকে পানের বাটা তাতে ভরা পরিস্কার একফালি ভিজে কাপড়ে মোড়া পান আর ছোট ছোট কাঁসার পাত্রে নানারকম মশলা। একজনের হাতে জাঁতি চলে মশর মশর তো আর একজন নিপুণ হাতে পানের বোঁটা ছিঁড়ে ছোট্ট একটি কাঠের ডাঁটি দিয়ে তাতে চূণ দেয়, মৌরী দেয়, অল্প দুকুচি কেয়া খয়ের। আর পা ছড়িয়ে রাজ্যের মনের কথা। ছোটছেলেদের জন্যে কাঁথা তৈয়ের তারই মধ্যে।বিকেলবেলা প্রথম আসে মেয়ে ইস্কুলের বাস।মেয়েদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় ঝি: “ওগো দোর খোলো মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে গেলুম!” কর্তারা ফেরার আগে চুল বেঁধে চওড়া পেড়ে শাড়ী, মাথায় ডগডগিয়ে সিঁদুর আর পানের রসে রাঙানো ঠোঁট। সন্ধেবেলা ভুবনমোহিনীর ছুটি। তিনি যে ওঠেন কাকভোরে!
দিব্যি ছিল শাশুড়ি বউয়ে। ভুবনমোহিনীর এককোলে নিজেরটি তো অন্যকোলে সেজবউয়ের সদ্য হওয়া-টি। কাকা পিসী ভাইপো ভাইঝি কে যে বড়, কে যে ছোট বোঝা ভার। সংসার বাড়ছে, ছোটবাড়িতে আর কুলোয় না, তাই না শহরতলীতে জমি কিনে বাড়ী বানানো?
– “তোদের দাদুরও বাপু একটু আদিখ্যেতা ছিল। কে বলেছিল বাড়ি আমার নামে লিখে দিতে?” কথায় বলে মানুষের মন না মতি। কিযে হলো খুড়িমার, ওনাকে গিয়ে বললেন: “বীরেন, আমারে ফরিদপুর পাঠায়ে দে”! বোঝো কান্ড!  আমার বরাবরই জ্ঞানগম্যি কম। উনি কিন্তু ঠিক বুঝেছিলেন”।
সেই প্রথম আর সেই শেষ বীরেন্দ্রনাথ পূর্ণলক্ষ্মীর অনুমতি চেয়েছিলেন। নতুন বাড়ির জমিতে কিছু গাছপালা ছিল। ভেবেছিলেন একদিকের কিছু ফলের গাছ রেখে দেবেন। ছেলেপিলেরা সময়ের ফল খাবেখ’ন। সেইখানে খুড়িমার একতলা দালান উঠলো। সদর দরজা আলাদা কিন্তু অন্দরমহলের যাতায়াতের পথটি জোড়া। দুই বাড়ির মাঝে পাঁচিল নেই। “নিজের বউএর বাড়ী প্রাসাদ- খান ,আর আমার লেগে মাঠকোঠা”!  ঠিক মাঠকোঠা ছিলনা সে বাড়ি। তবে হ্যাঁ, সে বাড়ির মেঝে লাল সিমেন্টের। সে বাড়ি একতলা। কিন্তু সেই বাড়ির ছাদে ছায়া দেয় দুটো মস্ত আমগাছ। বাড়ির  কাজের লোক সুদাম সে ছাদে পায়রা পোষে। এইবার ভুবনমোহিনী আর পূর্ণলক্ষ্মীর হেঁশেল  ভিন্ন হলো। কিন্তু কার ঘরে কে খায় তার ঠিক নেই। ভুবনমোহিনীর  কাছিমের মাংসের ঝাল বড় জামবাটিতে করে আসে বড়বাড়ি।  বীরেন ভলোবাসে। পূর্ণলক্ষ্মী পাঠান চেতল মাছের তেলঝোল। খুড়োমশাই ভালো খান।
ভুবনমোহিনী রোজ যা’ন ‘ও বাড়ি’। সকালবেলা নিজের বাড়ি গঙ্গাজল ছড়া দিয়ে গুরুনাম জপতে জপতে কমণ্ডলু নিয়ে ওবাড়ি মুক্ত করতে আসেন তিনি। বুড়ি আজকাল ভোরসকালে ওঠে। বীরেন রোজ গঙ্গাস্নানে বেরোন শেষরাতে, তাই বুড়িও উঠে পড়ে। খুড়িমার সকালবেলা বুড়ির মুখটি দেখে দিন শুরু করেন। বড় পয়মন্ত বউ। সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।  তবে কেন তিনি বলেছলেন : “তোর বউয়ের রাজত্যি তে থাকবোনা” ? বীরেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, তাই একটুও রাগেননি। শুধু অল্প হেসেছিলেন আর বলেছিলেন, “ঠিক আছে খুড়িমা. আপনাকে আমার বউয়ের সঙ্গে থাকতে হবেনা”। তারপরের বৃত্তান্ত তো জানা।দুটি নারী। সুখ দুঃখের সাথী। একজনের স্বামী অপদার্থ, অকর্মণ্য, ভ্রাতুষ্পুত্রের অন্নদাস। আর একজনের পায়ের তলে পড়ে থাকা স্বামীর জুড়িগাড়ি, সায়েব মক্কেল। বড়দিনে তারা ভেট পাঠায় আঙুর,  আপেল, শুকনো ফল, টাটকা মাখন। আর তারা সুন্দরবনে শিকারে গেলে তো কথাই নেই; সন্ধের ঝোঁকে উঠোনে পৌঁছে যাবে শিকার করা আস্ত হরিণ।শরীর জ্বলবে বৈকি। হোক না কেন ভাসুরপো-বউ মেয়ের বাড়া। হোলোই বা তাঁর বাপ মায়ের দেওয়া নাম ভুবনমোহিনী!
Image
                                    আনন্দমঠ এবং…

তোমরা যে গৃহলক্ষ্মী ধর্মসাক্ষী
জগৎভরে আছে জানা
চটকদার কাঁচের বালা ফুলের মালা
তোমাদের অঙ্গে শোভেনা
বলিতে লজ্জা করে প্রাণবিদরে
কোটি টাকারকম হবেনা
পুঁতি, কাঁচ, ঝুটো মুক্তোয় নেয় বিদেশী
এই বাংলায় কেউ জানেনা।।

মেয়েরা যেন ঝাঁকের কই। নীল ষষ্ঠী, শীতলষষ্ঠী, শিবরাত্রির উপোষ …ছোট দুখ ছোট সুখ…  বালীগঞ্জের লাহিড়ী বাড়ির  দুই গিন্নীই বা আলাদা কিসে? কিন্তু বড় দামাল যে তিরিশের দশক। দশদিক যেন উচাটন।  তার একটা ঢেউও কি তাদের লাগবেনা? ২৩শে মার্চ ১৯৩১ ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরু শহীদ হলেন। বীরেন্দ্রনাথ বাড়ী ফিরলেন বেশ রাতে। এক গেলাস জল খেয়ে শুতে গেলেন। শুধু বললেন, “কাল ছেলেমেয়েদের ইসকুল যাওয়ার দরকার নেই। কাল সারাদেশে আগুন জ্বলবে…”
–“ভয় পেয়েছিলে খুব, দিদা?”
–না রে, রাগে দুঃখে সারা শরীর কাঁপছিলো আমার। গান্ধী যে কিছুই করবেন না এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। উনিও না। মনে মনে বলছিলুম জ্বলুক আগুন, সব ছারেখারে যাক্”।
ততদিনে পূর্ণলক্ষ্মী রেশমের শাড়ি ছেড়েছেন। বিলিতি সাবান ছেড়েছেন। মেয়েদের কাঁচের চুড়ি পরা বন্ধ। পাড়ায় খুব হাসাহাসি ব্যাপার। লাহিড়ী বাড়ির বউ স্বদেশী হয়েছেন!
কোথায় যেন লাহিড়ী বাড়ির ‘তথাস্তু ‘ দেবী পূর্ণলক্ষ্মীর মনের কথাটুকু শুনে ফেলেছিলেন আর খুব হেসেছিলেন। আগুন জ্বলেছিলো।  খুব বেশীরকম।

(ক্রমশঃ…)

Friday, 7 March 2014

পূর্ণলক্ষ্মীর একাল সেকাল দ্বিতীয় পর্ব






বিষ্ণুপ্রিয়া পদ্মাসনা ত্রিতাপহারিণী
চঞ্চলা অচলা হও পাপনিবারণী।।
তোমার পদেতে মা মোর মিনতি
দুখ নাশিবার তব আছে গো শকতি।।

২: বীরেনের বৌ
 সংসারে ‘অখণ্ড পোয়াতি’ দের বড় মান্যি। গর্ভসঞ্চার থেকে শুরু করে প্রসব হওয়া অবধি কাকপক্ষীতে টের পায়না। সংসার চলে নিজের মনে। ভোরবেলা শাশুড়ীর পূজোর আসন গুছিয়ে দেওয়া থেকে  শুরু করে ছোট ছোট দেওরদের ইস্কুলের ভাত দেওয়া, সন্ধেবেলায় শ্বশুরমশাইয়ের আফিং টুকু খাওয়ার পর একবাটি ঘন ক্ষীর এগিয়ে দেওয়া, এইসব করেও তারা দিব্য ষোলো কলার মত বাড়তে থাকে তারপর যথাসময়ে ভিটের সবচেয়ে স্যাঁতস্যাতে ঘরে পুরোনো কাপড়চোপড়ের ওপর দাইয়ের নজরদারিতে সন্তানের জন্ম দেয়।  কাউকে জ্বালায়না, মৃত সন্তানও প্রসব করেনা। সব সন্তান অখণ্ডায়ূ হয়। এইসব লক্ষ্মীমন্ত বৌদৈর জনে্যই সংসার উথলে পড়ে। ঠিক যেন মাটির হাঁড়িতে জ্বাল দেওয়া গাইয়ের দুধ। তাই স্ত্রী-আচারে সাধের, অন্নপ্রাশনের পায়েস রান্নায় সবার আগে তাদের ডাক পড়ে।বিয়ের বরণডালার ‘ছিরি’ তৈয়েরের অগ্রাধিকার তাদের।
এইভাবেই শোভনা। ঠিক দেড় বছরের মাথায় করূণা। বীরেন্দ্রনাথ ল’ পাশ করে নতুন শামলা গায়ে চড়িয়েছেন। পূর্ণলক্ষ্মী চিঠি লিখতে আর ফুলঠাকুরপোকে ডাকেননা। রাতেরবেলা শাশুড়ী দরজা বন্ধ করলে, কোলের দুটিকে ঘুম পাড়িয়ে টেমি জ্বালিয়ে চিঠি লেখেন। আপনি কবে যেন ‘তুমি’তে গড়িয়েছে। অনেক বায়না: রবিবাবুর নতুন নবেলখানি, বিলাতি সাবান, মাথায় দেবার গন্ধ তেল,শোভনার ফ্রক,  বিস্কুট আরও কত কি।  কলকাতা কেমন শহর? সেকি ঢাকার চেয়েও বড়? সেখানে কি অনেক সাহেব মেম ? বড়লাটের বাড়ি কি ঢাকার নবাববাড়ির চেয়েও…?
       আরও অনেক কথা জমে থাকে। গ্রীষ্মের ছুটিতে বীরেন যখন আসেন তখন সেসব জমা কথার ফোয়ারা দুজনেরই। সুরেন বাঁড়ুজ্জের দিন শেষ। কে এক গান্ধীর কথা বলেন বীরেন্দ্রনাথ। তিনিই নাকি পরাধীন দেশবাসীকে পথ দেখাবেন। কিসের পথ…কিছু কুলকিনারা পাননা পূর্ণলক্ষ্মী। খালি যুবক স্বামীর কথা মাঝরাত জেগে মুগ্ধ হয়ে শোনেন। ‘দেশ’  ‘পরাধীনতা’   ‘প্রথম মহাযুদ্ধ’, নতুন নতুন সব কথা…বাইরে প্যাঁচা ডাকে।
--“তোমাদের এবার কলকাতায় নিয়ে যাবো ।শোভনা আর করূণার লেখাপড়ার বয়েস হচ্ছে। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ছি ঘনঘন আর আসতে পারবোনা” ।
১৯২৩। ফরিদপুরের মাদারিপুর সাবডিভিশনের রুকনি গ্রাম থেকে পাট উঠলো পূর্ণলক্ষ্মীর। তখন সে অন্তঃসত্ত্বা।  কলকাতার  ভবানীপুরে ১৯২৪ সালে বরেন্দ্রনাথের জন্ম। এতদিনে সেজবৌ সত্যি সত্যি পুতের মা।
ভাগি্যমানী সেজবৌ।



৩: কত সাধ যায় লো চিতে, মলের আগায় চুটকি দিতে…
          বরাবরই ঢাকা শহর নিয়ে গুমোর ছিল সেজ বঊয়ের। ভবানীপুরের বাসাবাড়িতে এসে তার সে গুমোর ভাঙলো। ভাড়া করা ফিটনে চেপে নিজের সেলাই করা নক্শী কাজ করা জ্যাকেট পরে সেই প্রথম গড়ের মাঠ, ফিরিঙ্গী কালীবাড়ি, বড়লাটের প্রাসাদ।

---“বাড়ি ফেরার পথে ভীমনাগের দোকান থেকে এক বারকোস সন্দেশ কিনে দিয়েছিলেন উনি।  ছেলে মেয়েদের নিতে দেননি আমার একটু মনখারাপ হয়েছিল, বুঝেছিলেন”।


সেজবউয়ের জগৎটা পাল্টাচ্ছিলো একটু একটু করে। কলের জল, গ্যাসের আলো, সারাটা সকাল দুপুর ফিরিওয়ালার ডাক, রিঠেভেজা জলে চুল ধুয়ে রোদে ফালি ফালি করে চুল শুকোনো। এছাড়া সংসারের হাল ধরার প্রথম পাঠ। দেশ থেকে সঙ্গে এসেছিলেন খুড়িমা। শাশুড়ী ছিলেন ভিটেবাড়ি আগলে।তাঁর রাজতি্য, বড় আর মেজ ছাওয়ালের সংসার, বাউণ্ডুলে শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ানো কালীসাধক স্বামী, এইসব নিয়ে রইলেন তিনি রুকনিতে। পাঠিয়ে দিলেন ছোট দেওরের সংসার।  বীরেন তো ছোটবউয়েরর কোলেই মানুষ। ‘খুড়িমা’ বলতে অজ্ঞান! সেই খুড়িমার হাতেই রান্নার হাতে খড়ি। বোয়াল মাছের ঝোল আলু বেগুন বড়ি দিয়ে। তাতে আদাবাটা আর টাটকা কাঁচালংকা। রান্না হলে সে ঝোল ঢালা হবে পাথরের জামবাটিতে। শিল নোড়া দিয়ে ঢাকা চাপা থাকবে সারারাত ছাদে। রাতের হিম পড়ে ভোরের বেলা সেই ঝোল হবে ক্ষীরের মত ঘন। সকালবেলা জাউ-ভাতে সেই ঝোল ঢেলে বাড়ির গিন্নীরা খাবে। ছেলেপিলে আর কর্তাদের অন্য বিধান। তারা খাবে সময়ের ফল, ছানা-মাখা, টাটকা দুধ, খই মুড়ি।
কিন্তু কোথায় একটা গোল বেঁধেছিলো পূর্ণলক্ষ্মীর জগতে। রান্নাবান্না, কুটনোবাটনা, খুড়িমাকে নিয়ে গঙ্গা স্নান, আরও দুএকটি সন্তানের জন্ম দেওয়া, এসবের বাইরেএকটা অন্য পৃথিবী কখন যেন তাকে ডাকতে শুরু করেছে। দুপুরবেলা শোবার ঘরে দোর দিয়ে খবরর কাগজের ওপর উপুড় হয়ে পড়া। বড় দামাল সময়। যাদের শুধু নামে চেনা ছিল তাদের সব ছবি দেখতো মুগ্ধ হয়ে। লোকমান্য তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিন পাল, আরও কতসব ঠাকুর দেবতার মত মানুষ। খবরের কাগজ যেন আগুন ওগরায়। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর… গলিতে গলিতে ব্যায়ামের আখড়া আর তাতে উঠতি বয়েসের ছেলেদের ভীড়। কেন যে এসব আখড়ায় টিকটিকিরা নজরদারি করে তা খানিক খানিক বোঝে সে।  স্বদেশীরা কেমন ধারার লোক? তাদের প্রাণে কি ভয় ডর বলে কিছ নেই? খুড়িমার সঙ্গে এ নিয়ে সে বলতে গেল একদিন। নথনাড়া খাওয়াই সার: “'লঙ্কাতে রাবণ ম’ল, বেউলা কেঁদে ব্যাকুল হ’ল!!!
‘বন্দেমাতরম্’ কথাটির মানে জানা হয়ে গেছে ততদিনে। এটাও জানা হয়ে গেছে ও এক মারণ মন্ত্র।  ততদিনে  আরও একটি ছেলে হয়েছে তার। বীরেন্দ্রনাথের পশার বেড়েছে।ভবানীপুরের বাসাবাড়ি থেকে তিনি উঠে এসেছেন  বালীগঞ্জের শহরতলীতে। সে পাড়া ভবানীপুরর মত সরগরম নয়। রাতবিরেতে শেয়াল ডাকে। বাড়ীর নাম ‘প্রসন্ন ভবন’, শ্বশুরমশাই ঈশ্বর প্রসন্ননাথ লাহিড়ীর নামে। সে বাড়ির মস্ত ছাদের একধারে একটা পুরোনো এনামলের বাথটাবে পূর্ণলক্ষ্মীর রজনীগন্ধার বাগান । জ্বাজ্জল্য সংসার, সুখের ভাত সুখে খাওয়া, পার্শী শাড়ি, সোনার ব্যাটবল ব্রোচ্ … দিব্যি কাটছিল দিন। বাদ সাধলো মণিঠাকুরপো। ছেলের মত দেওর। শোভনার চেয়ে অল্প বড় বীরেন্দ্রনাথের খুড়তুতো ভাই। ছেলে মেয়েদের মণিকাকা।
মলের আগায় চুটকি দেওয়া কই আর হলো পূর্ণলক্ষ্মীর ?

(ক্রমশঃ…)














Sunday, 2 March 2014

পূর্ণলক্ষ্মীর একাল সেকাল







এক :  সেজবউ
একে ধলীর ধলা গা
তাতে ধলী পুতের মা   (মেয়েলী ছড়া)

পূর্ণলক্ষ্মীর জীবনটা কেমন যেন ছিল। জন্ম হয়েছিল দার্জিলিং-এ ।এক আধা সাহেব বাবা আর এক একটু আধটু পড়তে জানা মায়ের প্রথম সন্তান। নেপালী আয়ার সঙ্গে থেকে থেকে নেপালীতে কথা বলা শুরু করেছিলো পর্যন্ত! কিন্তু বেশিদিন পাহাড়ে থ।কা হয়নি পূর্ণলক্ষ্মীর। অকন্যক জ্যেঠামশাই নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ঢাকায়। ছোটবউকে জিগেস পর্যন্ত করেননি তাঁর মত আছে কিনা। মা দূরের মানুষ রয়ে গেলো তাই সারা জীবন। পরে অবিশ্যি জ্যেঠামশাইর একটি  কোল-মোছা মেয়ে হয়, কিন্তু ততদিনেবুড়ি মার বিয়ের বয়েস হয়েছে। বয়েস হয়েছে না বলে বয়েস পেরিয়েছে বলাই ভালো।
– “বয়েস বাড়তে বাড়তে সে এক বিপর্যয় কাণ্ড! তার ওপর জ্যেঠাবাবু একদিন দেখে ফেললেন আমি       উঠোনে ভাইদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলছি!ব্যস, ভেতরবাড়ীতে এসে জ্যেঠিমার ওপর খুব খানিকটা চেঁচামেচি করে রেগেমেগে ভাত না খেয়ে আপিস চলে গেলেন। পরেরদিন গেলেন ফরিদপুর, বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। সেই বরযাত্রীর মধ্যে উনিছিলেন। এম্ এ পাশ দিয়ে তখন কলকাতায় লপড়ছেন। জ্যেঠাবাবু সোজা চলে গেলেন ওনাকেনিয়ে ওঁদের গ্রামের বাড়িতে। কথা পাকা করে তবে শান্তি! তারপর সেই যে কথায় আছে: ওঠ্ ছুঁড়ি তোর বিয়েবাবাকে অবিশ্যি বলেছিলেন জ্যেঠাবাবু একবার কলকাতায় গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতে, তা বাবা লিখে পাঠালেন:  ‘Will attend Buri’s marriage along with my wife’ ”!

১৯১৪ সালে ঢাকা শহরে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে। পূর্ণলক্ষ্মীর বয়স তখন বারো। বীরেন্দ্র নাথ বাইশ বছরের পূর্ণ যুবা। কলকাতার বাসায় থাকেন, রবিবাবুর কবিতা পড়েন, আর সুরেন বাঁড়ুজ্জের বক্তৃতা শুনতে যান টাউন হল। স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন স্বদেশীদের হয়ে মামলা লড়বেনতখন কি জানতেনসে যাক গে। ছেলেমানুষ বউকে চিঠি-ও লেখেন অবরে সবরেছেলেমানুষ বৌএর আরো ছেলেমানুষ ফুল ঠাকুরপো সে চিঠি ডাকসাইটে মায়ের হাতে পড়ার আগেই সেজবৌএর হাতে দিয়ে আসে (আ-লো, এমন নিলেজ্জ ছাওয়াল, বৌ-রে চিঠি দেয়!) বিনিময়ে পায় এক পয়সা। সেজবৌএর আধাসাহেববড়লোকবাপ মেয়েকে  তিনটাকা মাসোহারা পাঠাতেন কিনা? ফুলঠাকুরপো ছিলেন সমবয়সী। আর ছিলেন ছোট্ ঠাকুরপো। বিয়ের বারকোসে একথলে বিলিতি লজেন্স, রঙীন মঠ সব ভরে দিয়েছিলেন জ্যেঠিমা,  খিদে পেলে বউমানুষকে খিদে পেয়েছে বলতে নেই। তাতে সংসারে অলক্ষ্মী লাগে। শাশুড়ী বারকোস থেকে সেই থলি ভরা মেঠাই ছোট কে দিয়েছিলেন: আহা, বেয়ানের কি বুদ্ধিঘরভরা ছাওয়াল তাই মেঠাই দেছেনছোটর ওপর তাই রাগ ছিল বহুদিন

পূর্ণলক্ষ্মী জানত না সংসারে বৌমানুষদের একটা মস্ত কাজ থাকে। বুঝলো যখন শাশুড়ী মা একদিন পষ্টাপষ্টি শুনিয়ে দিলেন: 

পুরূষের চেয়ে প্রকৃতি সবলা
বিধিরোষে সে নারী অফলা।

সেই প্রথম খনার বচন।
সেই প্রথম লজ্জা।
সেই প্রথম ভয়।

শ্রীচরণকমলেষু,
বড় ভয়ে ভয়ে আপনাকে চিঠি লিখিতেছি। আজ অবধি আমার ছেলে হয় নাই, একারণে আপনার মাতা আপনার পুনরায় বিবাহ দিবেন। বাড়ীতে ঘটক আসিতেছে। আর আমি ভাল লিখিতে শিখি নাই
ফুল ঠাকুরপো বলিয়া দিয়াছে। ভুল হইলে দোষ তাহার।
প্রণাম জানিবেন।
 
ইতি আপনার
পুঁটুরাণী।

**************************
–“ও দিদা, —–  ব-ছ-র? কেন!!! নাতনীর যুগপৎ অট্টহাসি এবং আর্তনাদ।
–“বলি, ছেলের মা হওয়ার একটা রীতকানুন আছে সেটা বোঝোতো ? কি করে হবে শুনি? তিনি তো আসতেন ছুটিছাটায়। সারাদিনের পরে তোর মার ঠাকুরমা যখন সাজিয়ে গুজিয়ে ঘরে পাঠাতেন তখন শুরু হত মেঘনাদ বধ’, ‘সোনার তরীমুখস্থ। তারপর Cat mat Bat
 প্যারীচরণ সরকারের ফার্সট বুক। ঝিমুনি এলেই খোঁপা ধরে ঝাঁকুনি। কম জ্বালিয়েছেন তোদের দাদু সারাজীবন?”
*************************
পূর্ণলক্ষ্মী মা হয়েছিলেন বিয়ের ছয়বছর পরে। বীরেন্দ্রনাথ প্রথম মেয়ের নাম রেখেছিলেন শোভনা। শোভনার দৌলতে সেজবউ থেকে মা। তারপর করূণা, বরেন্দ্রনাথ , বারীন্দ্রনাথকোলজোড়া কোলভরা
সেজবউয়ের বড় দেমাক।অখন্ড পোয়াতি কিনা!  ঐ যে কথায় আছে না
একে ধলীর ধলা গা
 (ক্রমশ..)