ভুবনমোহিনী দেবী
ওই যে বলেছিলাম,
পূর্ণলক্ষ্মীর জীবনটা ছিল কেমন যেন? মা হলো দূর-পর, জ্যেঠিমা দিলো কোল
পেতে। শ্বশুরবাড়িরও সেই একই বৃত্তান্ত। শাশুড়ী রইলেন দূরে দূরে আর
খুড়শাশুড়ী ভুবনমোহিনী হলেন সঙ্গের সাথী। ভবানীপুরের দিনগুলো ছিলো ভালো।
সকালবলা দুটি ঝোলভাত নামিয়ে দেওয়া খুড়িমার তত্ত্বাবধানে। ঝাঁকা মাথায়
মেছুনি দোরে এসে মাছ নামাতো। কর্তাদের আর ছোট ছেলেদের বড় পাকা মাছ।
গিন্নীরা খাবেন ঝাল টক। তাই তাদের জন্যে সরপুঁটি, মৌরলা, বাটা। মাছের
ল্যাজা মুড়ো আর সময়ের তরকারি দিয়ে হবে চচ্চড়ি বাড়ির কাজের লোকদের জন্যে।
এছাড়া এক গামলা ডাল, নিমপাতা, উচ্ছেভাজা সরু সরু করে বেগুন দিয়ে। শেষ পাতে
অম্বল আর ঘরে পাতা দই। সে দই আবার কর্তাদের জন্যে পাতা হবে আলাদা
পাথরবাটিতে। ঘাঁটা -পারা দই কখনো তাঁরা খেতে পারেন? কি ঘেন্নার কথা!
ভোরবেলা উঠে শুরু হত যজ্ঞিবাড়ির রান্না। আর কিছু হোক চাই না হোক, মাছের
ঝোলটুকু আর বড় এক হাঁড়ি ভাত হতেই হবে। বীরেন্দ্রনাথ রাতের বেলা আমিষ, নোনতা
কিছুই খেতেন না। কোর্ট থেকে ফেরার পর তাঁর বরাদ্দ একথালা লুচি আর পাথরের
বাটিতে লালচে ক্ষীর। ছেলেপুলেদের দুধ-দই, কর্তাদের ক্ষীর ছানা, তাছাড়া
শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে সংসারটি বেশ ফুলন্ত ফলন্ত, সাধ, অন্নপ্রাশন, পৈতে
লেগেই আছে…দুধ কি কম লাগতো! গোয়ালা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতোনা। কালে ভদ্রে
ছানার ডালনা। তবে সে ছানা আসত বউবাজারের ছানাপট্টি থেকে।
এসব সামলাতে সামলাতে বেলা দুপুর হত। তারপর শাশুড়ী বউ-এ একটু হাঁপ জিরিয়ে নিয়ে চড়াতেন নিজেদের রান্না।
ভুবনমোহিনী বড়
অদ্ভূত শাশুড়ি। ডাক হাঁক নেই, বৌকে সহবৎ শিক্ষে দেবার একছিটে ইচ্ছে নেই।
এমনকি পরের বাড়ির মেয়েকে ‘বৌমা’ ডাকার কথাটা তাঁর মনেও আসেনি কখনো। ‘বুড়ি’
তাঁর সঙ্গের সাথী। প্রাণের কথা মনের কথা তারই সঙ্গে। “আ-লো বুড়ি, শুনিচিস,
বৌ-খেকো মিনসে এই বউডারেও খাইছে!” পাড়ার ললিত পাকড়াশি মশাই এর দ্বিতীয়
পক্ষর মৃত্যুতে ভুবনমোহিনীর অমর উক্তি। তা এরকম আরও কত কথা ছিল তাঁর:
প্রথম পক্ষ হেলাফেলা
দ্বিতীয় পক্ষ গলার মালা
তৃতীয় পক্ষ হরিনামের ঝোলা।
ছড়ার খেলা, বিন্তি
খেলা, , কতরকমই না খেলা মেয়েদের। দুপুরবেলা যখন বাড়ির মানুষরা গেছে রাজ্যি
জয় করতে আর ছেলেপিলেরা বিদ্যে শিক্ষে করতে, তখন ভাড়াবাড়ির সরু ঢাকা
বারান্দার যেদিকে রোদ পড়তো একফালি, সেখানে দুটি অসমবয়সী নারীর রাজ্যিপাট।
সামনে ঝকঝকে পানের বাটা তাতে ভরা পরিস্কার একফালি ভিজে কাপড়ে মোড়া পান আর
ছোট ছোট কাঁসার পাত্রে নানারকম মশলা। একজনের হাতে জাঁতি চলে মশর মশর তো আর
একজন নিপুণ হাতে পানের বোঁটা ছিঁড়ে ছোট্ট একটি কাঠের ডাঁটি দিয়ে তাতে চূণ
দেয়, মৌরী দেয়, অল্প দুকুচি কেয়া খয়ের। আর পা ছড়িয়ে রাজ্যের মনের কথা।
ছোটছেলেদের জন্যে কাঁথা তৈয়ের তারই মধ্যে।বিকেলবেলা প্রথম আসে মেয়ে
ইস্কুলের বাস।মেয়েদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় ঝি: “ওগো দোর খোলো মেয়েদের পৌঁছে
দিয়ে গেলুম!” কর্তারা ফেরার আগে চুল বেঁধে চওড়া পেড়ে শাড়ী, মাথায় ডগডগিয়ে
সিঁদুর আর পানের রসে রাঙানো ঠোঁট। সন্ধেবেলা ভুবনমোহিনীর ছুটি। তিনি যে
ওঠেন কাকভোরে!
দিব্যি ছিল শাশুড়ি
বউয়ে। ভুবনমোহিনীর এককোলে নিজেরটি তো অন্যকোলে সেজবউয়ের সদ্য হওয়া-টি।
কাকা পিসী ভাইপো ভাইঝি কে যে বড়, কে যে ছোট বোঝা ভার। সংসার বাড়ছে,
ছোটবাড়িতে আর কুলোয় না, তাই না শহরতলীতে জমি কিনে বাড়ী বানানো?
– “তোদের দাদুরও বাপু একটু আদিখ্যেতা ছিল। কে বলেছিল বাড়ি আমার নামে লিখে দিতে?” কথায় বলে মানুষের মন না মতি। কিযে হলো খুড়িমার, ওনাকে গিয়ে বললেন: “বীরেন, আমারে ফরিদপুর পাঠায়ে দে”! বোঝো কান্ড! আমার বরাবরই জ্ঞানগম্যি কম। উনি কিন্তু ঠিক বুঝেছিলেন”।
– “তোদের দাদুরও বাপু একটু আদিখ্যেতা ছিল। কে বলেছিল বাড়ি আমার নামে লিখে দিতে?” কথায় বলে মানুষের মন না মতি। কিযে হলো খুড়িমার, ওনাকে গিয়ে বললেন: “বীরেন, আমারে ফরিদপুর পাঠায়ে দে”! বোঝো কান্ড! আমার বরাবরই জ্ঞানগম্যি কম। উনি কিন্তু ঠিক বুঝেছিলেন”।
সেই প্রথম আর সেই
শেষ বীরেন্দ্রনাথ পূর্ণলক্ষ্মীর অনুমতি চেয়েছিলেন। নতুন বাড়ির জমিতে কিছু
গাছপালা ছিল। ভেবেছিলেন একদিকের কিছু ফলের গাছ রেখে দেবেন। ছেলেপিলেরা
সময়ের ফল খাবেখ’ন। সেইখানে খুড়িমার একতলা দালান উঠলো। সদর দরজা আলাদা
কিন্তু অন্দরমহলের যাতায়াতের পথটি জোড়া। দুই বাড়ির মাঝে পাঁচিল নেই। “নিজের
বউএর বাড়ী প্রাসাদ- খান ,আর আমার লেগে মাঠকোঠা”! ঠিক মাঠকোঠা ছিলনা সে
বাড়ি। তবে হ্যাঁ, সে বাড়ির মেঝে লাল সিমেন্টের। সে বাড়ি একতলা। কিন্তু সেই
বাড়ির ছাদে ছায়া দেয় দুটো মস্ত আমগাছ। বাড়ির কাজের লোক সুদাম সে ছাদে
পায়রা পোষে। এইবার ভুবনমোহিনী আর পূর্ণলক্ষ্মীর হেঁশেল ভিন্ন হলো। কিন্তু
কার ঘরে কে খায় তার ঠিক নেই। ভুবনমোহিনীর কাছিমের মাংসের ঝাল বড় জামবাটিতে
করে আসে বড়বাড়ি। বীরেন ভলোবাসে। পূর্ণলক্ষ্মী পাঠান চেতল মাছের তেলঝোল।
খুড়োমশাই ভালো খান।
ভুবনমোহিনী রোজ
যা’ন ‘ও বাড়ি’। সকালবেলা নিজের বাড়ি গঙ্গাজল ছড়া দিয়ে গুরুনাম জপতে জপতে
কমণ্ডলু নিয়ে ওবাড়ি মুক্ত করতে আসেন তিনি। বুড়ি আজকাল ভোরসকালে ওঠে। বীরেন
রোজ গঙ্গাস্নানে বেরোন শেষরাতে, তাই বুড়িও উঠে পড়ে। খুড়িমার সকালবেলা বুড়ির
মুখটি দেখে দিন শুরু করেন। বড় পয়মন্ত বউ। সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। তবে কেন তিনি
বলেছলেন : “তোর বউয়ের রাজত্যি তে থাকবোনা” ? বীরেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, তাই
একটুও রাগেননি। শুধু অল্প হেসেছিলেন আর বলেছিলেন, “ঠিক আছে খুড়িমা. আপনাকে
আমার বউয়ের সঙ্গে থাকতে হবেনা”। তারপরের বৃত্তান্ত তো জানা।দুটি নারী। সুখ
দুঃখের সাথী। একজনের স্বামী অপদার্থ, অকর্মণ্য, ভ্রাতুষ্পুত্রের অন্নদাস।
আর একজনের পায়ের তলে পড়ে থাকা স্বামীর জুড়িগাড়ি, সায়েব মক্কেল। বড়দিনে তারা
ভেট পাঠায় আঙুর, আপেল, শুকনো ফল, টাটকা মাখন। আর তারা সুন্দরবনে শিকারে
গেলে তো কথাই নেই; সন্ধের ঝোঁকে উঠোনে পৌঁছে যাবে শিকার করা আস্ত হরিণ।শরীর
জ্বলবে বৈকি। হোক না কেন ভাসুরপো-বউ মেয়ের বাড়া। হোলোই বা তাঁর বাপ মায়ের
দেওয়া নাম ভুবনমোহিনী!
আনন্দমঠ এবং…
তোমরা যে গৃহলক্ষ্মী ধর্মসাক্ষী
জগৎভরে আছে জানা
চটকদার কাঁচের বালা ফুলের মালা
তোমাদের অঙ্গে শোভেনা…
বলিতে লজ্জা করে প্রাণবিদরে
কোটি টাকারকম হবেনা
পুঁতি, কাঁচ, ঝুটো মুক্তোয় নেয় বিদেশী
এই বাংলায় কেউ জানেনা।।
মেয়েরা যেন ঝাঁকের
কই। নীল ষষ্ঠী, শীতলষষ্ঠী, শিবরাত্রির উপোষ …ছোট দুখ ছোট সুখ… বালীগঞ্জের
লাহিড়ী বাড়ির দুই গিন্নীই বা আলাদা কিসে? কিন্তু বড় দামাল যে তিরিশের
দশক। দশদিক যেন উচাটন। তার একটা ঢেউও কি তাদের লাগবেনা? ২৩শে মার্চ ১৯৩১
ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরু শহীদ হলেন। বীরেন্দ্রনাথ বাড়ী ফিরলেন বেশ রাতে।
এক গেলাস জল খেয়ে শুতে গেলেন। শুধু বললেন, “কাল ছেলেমেয়েদের ইসকুল যাওয়ার
দরকার নেই। কাল সারাদেশে আগুন জ্বলবে…”
–“ভয় পেয়েছিলে খুব, দিদা?”
–না
রে, রাগে দুঃখে সারা শরীর কাঁপছিলো আমার। গান্ধী যে কিছুই করবেন না এ আমি
স্বপ্নেও ভাবিনি। উনিও না। মনে মনে বলছিলুম জ্বলুক আগুন, সব ছারেখারে
যাক্”।
ততদিনে
পূর্ণলক্ষ্মী রেশমের শাড়ি ছেড়েছেন। বিলিতি সাবান ছেড়েছেন। মেয়েদের কাঁচের
চুড়ি পরা বন্ধ। পাড়ায় খুব হাসাহাসি ব্যাপার। লাহিড়ী বাড়ির বউ স্বদেশী
হয়েছেন!
কোথায় যেন লাহিড়ী বাড়ির ‘তথাস্তু ‘ দেবী পূর্ণলক্ষ্মীর মনের কথাটুকু শুনে ফেলেছিলেন আর খুব হেসেছিলেন। আগুন জ্বলেছিলো। খুব বেশীরকম।
(ক্রমশঃ…)


